পেটের বাম পাশে ব্যথা এবং আপনার যা জানা প্রয়োজন।
- >
- গর্ভাবস্থায় পেটের বাম পাশে ব্যথা হলে কীভাবে সামলাবেন এবং স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন তার সঠিক উপায়গুলি সম্পর্কে জানুন।
গর্ভাবস্থায় একজন মহিলাকে ব্যপক শরীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে
হয়। এ সকল পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পেটের বাম দিকে ব্যথা। কোন কোন
ক্ষেত্রে এ ব্যথা মারাত্মক হলেও এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছ ুনেই। তবে সম্ভাব্য
কারণগুলি সম্পর্কে ধারণা রাখা গর্ভবতী মায়েদের যত্ন নেওয়ার জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় পেটের বাম দিকের ব্যথার সাধারণ কারণগুলো
গর্ভাবস্থায় পেটের বাম দিকের ব্যথার সাধারণ কারণ
গ্যাস ও পেট ফাঁপা
গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিতে পারে, যার ফলে
গ্যাস এবং ফোলাভাব বৃদ্ধি পায়। এটি অস্বস্তি এবং ব্যথার কারণ হতে পারে এবং
অন্ত্রের স্বাভাবিক অবস্থানের কারণে সাধারণত পেটের বাম দিকে এই ব্যথা অনুভূত
হয়।
বৈশিষ্ট্য: পেট কামড়ানো বা ফোলা
অনুভূতি, সামান্য ব্যথা যা বায়ু ত্যাগ বা মলত্যাগের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়
।
করণীয়:
- অল্প ও ঘন ঘন খাবার খান।
- গ্যাস সৃষ্টি করে এমন খাবার এড়িয়ে চলুন (যেমন শিম, কার্বনেটেড পানীয় এবং কিছু শাকসবজি)।
- হাইড্রেটেড থাকুন অর্থাৎ বেশি করে তরল খাবার খান।
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন ।
কোষ্ঠকাঠিন্য
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য আরেকটি সাধারণ সমস্যা যা হরমোনের পরিবর্তন এবং
অন্ত্রের উপর ক্রমবর্ধমান জরায়ুর চাপের কারণে
হয়। এটি পেটের বাম দিকে অস্বস্তি এবং ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
বৈশিষ্ট্য: পায়খানা না হওয়া বা খুব কম
হওয়া, শক্ত ও শুকনো মল, তলপেটে ব্যথা এবং পেটে কামড়।
করণীয়:
- বেশি করে ফাইবার গ্রহণ (ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য)।
- প্রচুর পানি পান করা।
- নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ ।
ব্র্যাক্সটন হিকস সংকোচ
ব্র্যাক্সটন হিকস সংকোচন, যা "অনুশীলন" সংকোচন আবার কখনো কখোনো "ফলস পেইন"
নামেও পরিচিত। এটি দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে শুরু হতে পারে । এই ধরণের সংকোচন
সাধারণত অনিয়মিত এবং প্র¯্রববেদনার মতো তীব্র ব্যথার উদ্রেক করে না। গর্ভবতী
মায়ের পানিশূন্যতা, অতিরিক্ত পরিশ্রম, শারীরিক মিলন, পরিপূর্ণ মূত্রথলি
প্রভৃতি কারণে এ ধরণের ব্যথা হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য: অনিয়মিত সংকোচন অর্থাৎ
একটানা দীর্ঘসময় ধরে ব্যথা থাকবে না, পেট শক্ত হয়ে যাওয়া, পেটের এক বা উভয়
পাশে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
করণীয়:
- বিশ্রাম এবং অবস্থান পরিবর্তন অর্থাৎ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে বা বসে না থাকা।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৩—৪ লিটার পানি অথবা অন্য কোন তরল খাবার যেমন দুধ, ফলের রস ইত্যাদি পান
- দীর্ঘক্ষণ প্র¯্রাব আটকে না রাখা।
- বাম কাত হয়ে শোয়া।
রাউন্ড লিগামেন্ট ব্যথা
রাউন্ড লিগামেন্ট হলো জরায়ুর পাশে দুটি পেশি যা জরায়ুকে পেলভিসের সাথে
সংযুক্ত রাখে। গর্ভাবস্থার সময়, গর্ভের বৃদ্ধি এবং প্রসারণের কারণে এই
লিগামেন্টগুলি প্রসারিত হয় এবং টান পড়ে, যা ব্যথার কারণ হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য: পেটের নিচের অংশে বা তলপেটে তীব্র বা ধারালো ব্যথা, পেটের এক
পাশে বা উভয় পাশে ব্যথা হতে পারে, ব্যথা সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হয় এবং কয়েক
সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে, হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন, হাঁচি,
কাশি বা সজোরে হাসার সময় ব্যথা তীব্র হতে পারে।
করণীয়: রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন সাধারণত নিজে নিজেই চলে যায়, তবে কিছু
ব্যবস্থাপনা নিতে পারেন ব্যথা কমানোর জন্য যেমন—
- ধীরে ধীরে অবস্থান পরিবর্তন করুন, হঠাৎ উঠে দাঁড়াবেন না।
- ব্যথা হলে শুয়ে বিশ্রাম নিন।
- ব্যথার স্থানে হালকা গরম সেঁক দিতে পারেন।
- হালকা মাসাজ ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- হালকা প্রসারণমূলক ব্যায়াম করুন যা লিগামেন্টগুলির স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে।
- মূত্রনালীর সংক্রমণ (ইউটিআই)
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ খুব সাধারণ বিষয় এবং এক্ষেত্রে তলপেটে
ব্যথা এবং অস্বস্তি হতে পারে। তবে চিকিৎসা না করা হলে তা থেকে কিডনি সংক্রমণের
মত গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য: প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, তীব্র
গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, তলপেটে বা কখনও কখনও পেটের একপাশে ব্যথা ।
করণীয়:
- প্রচুর পানি পান করা ।
- ঘন ঘন এবং সম্পূর্ণরূপে প্রস্রাব করা ।
- একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর নির্দেশ অনুসারে নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ ।
- এক্টোপিক প্রেগনেন্সি
- অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি ঘটে যখন একটি নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুর বাইরে, সাধারণত কোন একটি ফ্যালোপিয়ান টিউবে ইমপ্লান্টেড হয় । এই অবস্থায় গুরুতর ব্যথা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
বৈশিষ্ট্য: পেটের একপাশে তীব্র ব্যথা, যোনিপথে রক্তপাত, মাথা ঘোরা বা
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, কাঁধে ব্যথা (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে ডায়াফ্রাম
জ্বালা করে) ।
করণীয়:
- এক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় এবং এক্টোপিক গর্ভাবস্থা অপসারণের জন্য ওষুধ বা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে ।
গর্ভপাত
পেটের একপাশে ব্যথা, বিশেষ করে যদি ব্যথার সাথে গুরুতর রক্তপাত হয় তবে
গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকতে পারে। বিশেষ করে প্রথম ত্রৈমাসিকে এই সম্ভাবনা বেশী
থাকে।
বৈশিষ্ট্য: পেটে তীব্র ব্যথা বা ক্র্যাম্পিং, যোনি থেকে রক্তপাত, যোনি থেকে
টিস্যুর নিঃসরণ।
করণীয়:
- অবিলম্বে চিকিৎসা সেবা নেওয়া।
- রোগীকে মানসিক সাপোর্ট এবং কাউন্সেলিং ।
- প্ল্যাসেন্টাল অ্যাব্রাপশন
একটি বিরল কিন্তু গুরুতর অবস্থা যেখানে প্রসবের আগে জরায়ুর প্রাচীর থেকে
প্লাসেন্টা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি গুরুতর ব্যথা এবং রক্তপাতের কারণ
হতে পারে যা মা এবং শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বৈশিষ্ট্য: হঠাৎ তীব্র পেটে ব্যথা, যোনিপথে রক্তপাত, কোমল বা অনমনীয়
জরায়ু , দ্রুত সংকোচন ।
করণীয়:
- অবিলম্বে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- ব্যথার তীব্রতার উপর নির্ভর করে হাসপাতালে ভর্তি, পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজন হলে জরুরী ডেলিভারির ব্যবস্থা করা।
অকাল প্রসব
অকাল প্রসব হলো গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই শিশুর
জন্মগ্রহণ। সাধারণত গর্ভাবস্থা ৪০ সপ্তাহ ধরে চলে, তাই ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার
আগে জন্ম নেয়া শিশুদেরকে প্রি—টার্ম বা অকালজাত শিশু বলা হয়। অকাল প্রসবের
কারণে শিশুর বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, যেমন শ্বাসকষ্ট, খাওয়ার
সমস্যা, এবং শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশের সমস্যা।
বৈশিষ্ট্য: নিয়মিত গর্ভাশয়ের সংকোচন, তলপেটে চাপ বা
ব্যথা, পিঠে নিচের দিকে ক্রমাগত ব্যথা, পেট খিঁচুনি, যোনি থেকে তরল পদার্থ
নিঃসরণ, অস্বাভাবিক রক্তপাত।
করণীয়:
- নিয়মিত প্রি—নাটাল চেকআপ।
- সঠিক খাদ্য গ্রহণ, পরিমিত ব্যায়াম, এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম।
- মানসিক চাপ কমানো এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা।
- কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক নির্দিষ্ট ওষুধ দিয়ে অকাল প্রসব প্রতিরোধ করতে পারেন।
- গর্ভাবস্থায় পেটের বাম পাশে ব্যথার পাশাপাশি নিম্নোক্ত কোন লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন:
ক্স
তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: যদি ব্যথা খুব তীব্র হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
ক্স
রক্তপাত: যদি ব্যথার সাথে রক্তপাত হয়।
ক্স
জ্বর: যদি ব্যথার সাথে জ্বর থাকে।
ক্স
প্রস্রাবে জ্বালা: যদি প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালা হয়।
পরিশিষ্ট
গর্ভাবস্থায় পেটের বাম পাশে ব্যথা সাধারণত স্বাভাবিক একটি ঘটনা, তবে কিছু
ক্ষেত্রে এটি গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। ব্যথার কারণ সঠিকভাবে নির্ণয়
এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকার নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় মায়েদের
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর
ফলে মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
কমেন্ট করুন
comment url